অতীত বার বার ফিরে আসে বর্তমান হয়ে, বাংলাদেশ বুঝি সিকিমই হতে চলেছে !!
হিমালয় পাদদেশে ছোট্ট স্বাধীন দেশ সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নের একত্রিত করার বিল ভারতের পার্লামেন্টে আনা হয় ১৯৭৪ সালের ৪ই সেপ্টেম্বর। ঐ বিল পাশ হয় ৩১০-৭ ভোটে। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই-এম) বিপক্ষে ভোট দেয় এবং সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের মে মাসে। সিকিমকে পাকাপোক্তভাবে একটি অঙ্গরাজ্য করা হয়। এর আগে ব্রিটিশ ভারতে সিকিম ছিলো একটি আশ্রিত রাজ্য। স্বভুমিজাত লেপচা উপজাতীয়রা সিকিমের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও পোষাক। উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে তিব্বত থেকে ভুটিয়ারা ও নেপালিরা এসে বসতি স্থাপন করে। শিকিমে ৩টি ভাষা এখন প্রধান- লেপচা, ভুটানী ও নেপালী।
চতুদর্শ শতক থেকে নামগিয়াল বংশ সিকিমে রাজত্ব করে আসছিলো। প্রথম শাসক পুনটমং নামগিয়াল। ১৬৪২ সালে চোহিয়াল উপাধিতে ভূষিত করা হয় যার অর্থ ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরন করে যিনি রাজ কার্য পরিচালনা করেন। সর্বশেষ চোগিয়ালকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ১৯৭৫ সালে।
৭২৯৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই ছোট্ট দেশটির রাজধানী গ্যাংটক। ১৮৮৬ সালে এক চুক্তির অধীনে সিকিম আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্জাদায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যোগ দেয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে ঐ চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৫০ সালে ভারতের সাথে সিকিমের চুক্তি হয়। ঐ চুক্তিতে সিকিমকে ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্জাদা দেয়া হয়। চুক্তির অধীনে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখাশুনার পুরো কর্তৃত্ব ভারত নিয়ে নেয়।
চোগিয়াল ২৪ সদস্যের কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশের শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। এর মধ্যে ১৮ জন নির্বাচিত এবং ৬ জন চোগিয়াল মনোনীত। কাউন্সিলের ৩টি দলের প্রতিনিধি ছিল- ন্যাশনাল পার্টি, সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ও সিকিম জনতা কংগ্রেস।
১৯৭৩ সালের মার্চ এপ্রিলে ন্যাশনাল কংগ্রেস ও জনতা কংগ্রেস রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তোলেন। এবং এই দাবিতে আন্দোলন দিনে দিনে তুমুল হতে থাকে। চোগিয়ালের অনুরোধে ভারতীয় পুলিশ আইনশৃংখলা রক্ষা করে। ঐ ১৯৭৩ সালের ১৩ই এপ্রিল ঘোষনা করা হয় যে, চোগিয়াল রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি মেনে নিতে রাজি আছেন। এছাড়া তার আর উপায়ও কিছু ছিল না। কারণ, তিনি স্পষ্ট অনুধাবন করেন এই আন্দোলনের পিছনে শক্তি কে? পরবর্তীকালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা স্বীকার করেছেন যে, আন্দোলনের পিছনে তাদের ভুমিকা ছিল। সংস্কারে রাজি না হলে সিংহাসন থেকে উৎখাত করা হবে। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন নিশ্চিত তাই সিকিমের সাতন্ত্র রক্ষার চেষ্টায় রাজনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকার করেন। অঙ্গীকার মোতাবেক ১৯৭৪ সালের জুন মাসে সিকিম রাষ্ট্র আইনে পরিবর্তন আনা হয়। ঐ আইনের অধীনে চোগিয়ালের সর্বোচ্চ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি হন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। অবশ্য, আইন পরিষদে পাশ হওয়া আইন অনুমোদনের ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়। এতেও শেষ রক্ষা হলো না। তাকে বিদায় নিতে হলো চিরদিনের মতো।
রাজনৈতিক সংস্কার অধীনে ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই সিকিমে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। দলটি আইন পরিষদের ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসন পায়। দলের নেতা কাজী লেন্দুপ দরজি হলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারত যা চাইছিল, সেটাই ঘটলো। কাজী লেন্দুপ দরজি তো তাদেরই লোক।
এই নির্বাচনের পর সিকিমকে ভারতের অঙ্গীভুত করার প্রস্তুতি নেয় ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু এর জন্য একটা বৈধতার প্রলেপ দরকার। সেটা করে দিলেন কাজী লেন্দুপ দরজি। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বললেন: ভারতের দুই পরিষদ- লোকসভা ও রাজ্যসভায় সিকিমের প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করেও সিকিমকে আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদায় রাখা যেতে পারে।
কাজী লেন্দুপ দরজি যেহেতু আইন পরিষদের ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসনের নেতা, তার মতামতই তো সিকিম জনগনের মতামত। সুযোগটা হাতছাড়া করলো না ভারত। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫০ সালের চুক্তি, যাতে সিকিমকে আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়, তা বাতিল করলো। সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্য করার বিল আনা হলো পার্লামেন্টে। এই বিল সম্পর্কে চোগিয়াল এক বিবৃতিতে বললেন :
‘সিকিমের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, যার নিশ্চয়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, ১৯৫০ সালের চুক্তিতে তা সিকিম জনগনের সম্মতি ছাড়াই এবং অজ্ঞাতে ভারতীয় পার্লামেন্টে সিকিমের প্রতিনিধি নেয়ার ত্বরিত পদক্ষেপে অস্বিকার করা হয়েছে।“
প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধির কাছে প্রেরিত এক বার্তায় চোগিয়াল বলেছেন যে বর্তমানে যে পদক্ষেপ, যা হবে “১৯৫০ সালের চুক্তির এক পার্শ্বিক বাতিলের সামিল এবং ভারতের সাথে সিকিমের একীকরণ।“
তিনি বলেন, ”ভারত-সিকিম সম্পর্কের সর্বোচ্চ আশ্বাস দেয়া হয় ভারত প্রদত্ত সিকিমের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার রক্ষাকবচের মাধ্যমে।“
(কলকাতা থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক দি অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ১৯৭৪)
https://docs.google.com/file/d/0B8_eJqXj-53aQXhaWHR1bWlMeVE/edit?pli=1
হিমালয় পাদদেশে ছোট্ট স্বাধীন দেশ সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নের একত্রিত করার বিল ভারতের পার্লামেন্টে আনা হয় ১৯৭৪ সালের ৪ই সেপ্টেম্বর। ঐ বিল পাশ হয় ৩১০-৭ ভোটে। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই-এম) বিপক্ষে ভোট দেয় এবং সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের মে মাসে। সিকিমকে পাকাপোক্তভাবে একটি অঙ্গরাজ্য করা হয়। এর আগে ব্রিটিশ ভারতে সিকিম ছিলো একটি আশ্রিত রাজ্য। স্বভুমিজাত লেপচা উপজাতীয়রা সিকিমের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও পোষাক। উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে তিব্বত থেকে ভুটিয়ারা ও নেপালিরা এসে বসতি স্থাপন করে। শিকিমে ৩টি ভাষা এখন প্রধান- লেপচা, ভুটানী ও নেপালী।
চতুদর্শ শতক থেকে নামগিয়াল বংশ সিকিমে রাজত্ব করে আসছিলো। প্রথম শাসক পুনটমং নামগিয়াল। ১৬৪২ সালে চোহিয়াল উপাধিতে ভূষিত করা হয় যার অর্থ ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরন করে যিনি রাজ কার্য পরিচালনা করেন। সর্বশেষ চোগিয়ালকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ১৯৭৫ সালে।
৭২৯৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই ছোট্ট দেশটির রাজধানী গ্যাংটক। ১৮৮৬ সালে এক চুক্তির অধীনে সিকিম আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্জাদায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যোগ দেয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে ঐ চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৫০ সালে ভারতের সাথে সিকিমের চুক্তি হয়। ঐ চুক্তিতে সিকিমকে ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্জাদা দেয়া হয়। চুক্তির অধীনে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখাশুনার পুরো কর্তৃত্ব ভারত নিয়ে নেয়।
চোগিয়াল ২৪ সদস্যের কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশের শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। এর মধ্যে ১৮ জন নির্বাচিত এবং ৬ জন চোগিয়াল মনোনীত। কাউন্সিলের ৩টি দলের প্রতিনিধি ছিল- ন্যাশনাল পার্টি, সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ও সিকিম জনতা কংগ্রেস।
১৯৭৩ সালের মার্চ এপ্রিলে ন্যাশনাল কংগ্রেস ও জনতা কংগ্রেস রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তোলেন। এবং এই দাবিতে আন্দোলন দিনে দিনে তুমুল হতে থাকে। চোগিয়ালের অনুরোধে ভারতীয় পুলিশ আইনশৃংখলা রক্ষা করে। ঐ ১৯৭৩ সালের ১৩ই এপ্রিল ঘোষনা করা হয় যে, চোগিয়াল রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি মেনে নিতে রাজি আছেন। এছাড়া তার আর উপায়ও কিছু ছিল না। কারণ, তিনি স্পষ্ট অনুধাবন করেন এই আন্দোলনের পিছনে শক্তি কে? পরবর্তীকালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা স্বীকার করেছেন যে, আন্দোলনের পিছনে তাদের ভুমিকা ছিল। সংস্কারে রাজি না হলে সিংহাসন থেকে উৎখাত করা হবে। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন নিশ্চিত তাই সিকিমের সাতন্ত্র রক্ষার চেষ্টায় রাজনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকার করেন। অঙ্গীকার মোতাবেক ১৯৭৪ সালের জুন মাসে সিকিম রাষ্ট্র আইনে পরিবর্তন আনা হয়। ঐ আইনের অধীনে চোগিয়ালের সর্বোচ্চ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি হন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। অবশ্য, আইন পরিষদে পাশ হওয়া আইন অনুমোদনের ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়। এতেও শেষ রক্ষা হলো না। তাকে বিদায় নিতে হলো চিরদিনের মতো।
রাজনৈতিক সংস্কার অধীনে ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই সিকিমে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। দলটি আইন পরিষদের ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসন পায়। দলের নেতা কাজী লেন্দুপ দরজি হলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারত যা চাইছিল, সেটাই ঘটলো। কাজী লেন্দুপ দরজি তো তাদেরই লোক।
এই নির্বাচনের পর সিকিমকে ভারতের অঙ্গীভুত করার প্রস্তুতি নেয় ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু এর জন্য একটা বৈধতার প্রলেপ দরকার। সেটা করে দিলেন কাজী লেন্দুপ দরজি। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বললেন: ভারতের দুই পরিষদ- লোকসভা ও রাজ্যসভায় সিকিমের প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করেও সিকিমকে আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদায় রাখা যেতে পারে।
কাজী লেন্দুপ দরজি যেহেতু আইন পরিষদের ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসনের নেতা, তার মতামতই তো সিকিম জনগনের মতামত। সুযোগটা হাতছাড়া করলো না ভারত। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫০ সালের চুক্তি, যাতে সিকিমকে আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়, তা বাতিল করলো। সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্য করার বিল আনা হলো পার্লামেন্টে। এই বিল সম্পর্কে চোগিয়াল এক বিবৃতিতে বললেন :
‘সিকিমের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, যার নিশ্চয়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, ১৯৫০ সালের চুক্তিতে তা সিকিম জনগনের সম্মতি ছাড়াই এবং অজ্ঞাতে ভারতীয় পার্লামেন্টে সিকিমের প্রতিনিধি নেয়ার ত্বরিত পদক্ষেপে অস্বিকার করা হয়েছে।“
প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধির কাছে প্রেরিত এক বার্তায় চোগিয়াল বলেছেন যে বর্তমানে যে পদক্ষেপ, যা হবে “১৯৫০ সালের চুক্তির এক পার্শ্বিক বাতিলের সামিল এবং ভারতের সাথে সিকিমের একীকরণ।“
তিনি বলেন, ”ভারত-সিকিম সম্পর্কের সর্বোচ্চ আশ্বাস দেয়া হয় ভারত প্রদত্ত সিকিমের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার রক্ষাকবচের মাধ্যমে।“
(কলকাতা থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক দি অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ১৯৭৪)
https://docs.google.com/file/d/0B8_eJqXj-53aQXhaWHR1bWlMeVE/edit?pli=1